আসুন জেনে নিই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে!
করোনা কী?
কোভিড-১৯ যা করোনাভাইরাস নামে পরিচিত, অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং হালকা জ্বরসহ নানা লক্ষণ দেখা দিতে পারে। কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কমক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
করোনার লক্ষণঃ
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার মূল লক্ষণ জ্বর, কাশি, শ্বাস নিতে সমস্যা। এছাড়াও মাঝে মাঝে শরীর ব্যথা, ক্লান্তি, মাথাব্যথা প্রভৃতি বিভিন্ন লক্ষণ দেখা যায়। অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।
কীভাবে ছড়ায়?
করোনাভাইরাস ছড়ানোর মূল মাধ্যম হচ্ছে, কাছাকাছি মানুষের সংস্পর্শ। এই ভাইরাস মূলত মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি আর কাশি দিয়ে বের হয় জীবাণু। সেই জীবাণুযুক্ত হাঁচি-কাশির ফোঁটা যদি সুস্থ মানুষের নাকে, মুখে বা চোখে পড়ে- জীবাণু ঢুকে যেতে পারে শরীরে। আপনি আক্রান্ত ব্যক্তির ৬ ফুটের ভেতরে থাকলে, বাতাসে থাকা সেই ভাইরাস আপনার শ্বাসের সঙ্গেও ফুসফুসে ঢুকে পড়তে পারে। এটাই এই ভাইরাস ছড়ানোর প্রধান উপায়- মানুষের কাছাকাছি সংস্পর্শ।
যাদের মধ্যে রোগের লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে (জ্বর, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি), অর্থাৎ যারা সবচেয়ে বেশি অসুস্থ তাদের মাঝেই করোনাভাইরাসে সংক্রামনের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। যাদের শরীরে জীবাণু রয়েছে কিন্তু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তারাও রোগ ছড়াতে পারে। তাই সবসময় সাবধান থাকা ভালো।
তাছাড়া, সুস্থ কেউ হাত দিয়ে জীবাণুযুক্ত কোনো তল স্পর্শ করার পর সেই হাত দিয়ে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ করলেও আক্রান্ত হতে পারে। ধরা যাক, কোনো একজন আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশির সময় হাত দিয়ে মুখ ঢেকেছেন কিন্তু সেই হাত আর পরিষ্কার করেননি। এরপর সেই হাত দিয়ে সিঁড়ির রেলিং, দরজার হাতল, বেসিনের কল ধরেছেন। জীবাণু লেগে গেছে সেখানেও। আপনি সেগুলো ধরেছেন মানে আপনার হাতেও লেগে গেছে জীবাণু। তারপর আপনিও আর হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করেননি। ধরেছেন নিজের নাক, মুখ, চোখ। জীবাণু ঢুকে যাবে আপনার শরীরেও।
করোনা প্রতিরোধঃ
সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে বারবার (বিশেষ করে হাঁচি-কাশির পর এবং পাবলিক প্লেস থেকে ঘরে ফেরার পর)। সাধারণ সাবানই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। সাবানের অণুগুলো ভাইরাসের শরীরের চর্বির দেয়াল ভেঙে ভাইরাসকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। সাবান না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা যেতে পারে যেখান অ্যালকোহলের পরিমাণ ৬০% এর বেশি। হাত পানিতে ভিজিয়ে এরপর সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধুতে হবে। নখের নিচে আঙুলের ভাঁজে, হাতের উল্টো পৃষ্ঠ ভালো করে ধুতে হবে।
হাঁচি-কাশি এলে হাতের তালু দিয়ে নয় বরং কনুই দিয়ে ঢাকতে হবে। সাথে টিস্যু পেপার থাকলে, তা ব্যবহার করুন। এরপর টিস্যু পেপারটি সাথে সাথে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। নাকে, মুখে, চোখে, হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
হাঁচি- কাশি হচ্ছে এমন কারো ৬ ফুটের ভেতর আসবেন না। হ্যান্ডশেক বাদ দিন। অপ্রয়োজনে বা স্বল্প প্রয়োজনে ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। জনসমাবেশে যাওয়ার দরকার নেই। যদি আপনি নিজে হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হন, নিজ দায়িত্বে বাসায় থাকুন। কোথাও বের হবেন না। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোটাই এই রোগের ছড়ানোর মূল মাধ্যম। একে বড় আকারে প্রতিহত করার জন্য, একে অপর থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই।
চীনের উহানে সব লকডাউন করে ফেলার পর নতুন করে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। একে অপর থেকে দূরে থাকার কারণে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আছে। ইতালি দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে এবং পুরো দেশ এখন লকডাউনে। কেউ ঘর থেকে বেরোবেন না খুব খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া।
কিছু ভুল ধারণাঃ
করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের মাঝে বেশ কিছু ভুল ধারণা আছে। আসুন, সেসব ভুল ধারণা দূর করে সঠিক তথ্য জেনে নিই।
গরমের দেশে করোনা ছড়ায় কি? হ্যাঁ ছড়ায়!
গরমের দেশে এই ভাইরাস বেশি ছড়ায় না- এটা খুবই বিপজ্জনক ভুল তথ্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র একটি ওয়েবসাইট আছে ‘Myth Busters’ নামে। সেখানে প্রথমেই বলা আছে ‘COVID-19 virus can be transmitted in areas with hot and humid climates’। এখন পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্য বলছে গরম এবং আর্দ্র এলাকাতেও COVID-19 রোগ ছড়াতে পারে। গরম দেশ ভেবে নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কিছু নাই। মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত সৌদি আরব, মিশরে, ভারত, ইরাক – সব জায়গায় ১০০-এর উপরে ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। এগুলো কোনোটাই ঠান্ডার দেশ না।
সবাইকে কি মাস্ক পরতে হবে? না !
যারা নিজেরা অসুস্থ, যারা স্বাস্থ্যকর্মী এবং যারা রোগির দেখাশোনা করছে তাদেরকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে আপনি যদি সুস্থ হন, বিনা কারণে মাস্ক পরার দরকার নেই। একই কথা বলেছে Center for Disease Control – CDC। আপনি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজন কোনো রোগির দেখাশোনা করেন, তাহলে নিজেকে সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরুন। যদি আপনি নিজে হাঁচি বা কাশিতে আক্রান্ত হন, তাহলে মাস্ক পরুন, যেন আপনার থেকে জীবাণু আর না ছড়াতে পারে। তারা এটাও বলছে যে শুধু মাস্ক পরে নিজেকে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত রাখা যাবে না। সাথে সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোঁয়া, হাঁচি-কাশি এলে কনুই বা টিস্যু দিয়ে ঢাকা- এগুলোর চর্চাও লাগবে।
যদি মাস্ক ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে সেটা ব্যবহারের সঠিক নিয়মটাও জেনে রাখতে হবে। কী করে পরতে হয়, কী করে খুলতে হয়, কোথায় কীভাবে ফেলতে হয়- এগুলোও জানাটা জরুরি। নিচের ভিডিওতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কর্মী জানাচ্ছেন মাস্ক ব্যবহারের নিয়মাবলি।
শিশুরা কি আক্রান্ত হয়? সব বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সব বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে।
যতদূর জানা গেছে বৃদ্ধ কিংবা বয়স্করা যদি আক্রান্ত হয় তাদের ক্ষেত্রে রোগের জটিলতা বেশি হবার সম্ভাবনা আছে, শিশুদের ক্ষেত্রে রোগটা মারাত্মক আকার ধারণ করে না। তাই বলে শিশুদের কিছু হবে না ভেবে অবহেলা করার মানে নেই। তাদের জন্য রোগের ভয়াবহতা হয়তো বেশি হবে না, কিন্তু তারা বাহক হিসেবে এই রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে অসুস্থ কিংবা ঝুকিপূর্ণ মানুষের কাছে।
যারা বয়স্ক এবং দেহে আগে থেকেই কোনো অসুস্থতা আছে (যেমন: অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ), তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
করোনা চিকিৎসাঃ
আপনার জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, ম্যাজ ম্যাজ ভাব, শরীর ব্যথা, হাঁচি, কাশি, সর্দি এসব উপসর্গ যদি থাকে, তবে শ্বাসকষ্ট না থাকে- তাহলে বাড়িতেই থাকুন এবং নিম্নোক্ত নিয়মসমূহ মেনে চলুনঃ
কুসুম গরম পানি পান করুন ও গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করুন। দিনে অন্ততঃ দুইবার শরীরের তাপমাত্রা মাপুন। বাড়ির অন্যদের থেকে আলাদা থাকুন। বাড়িতে অতিথিদের আসা বন্ধ করুন। মাস্ক পড়ুন। হাত দিয়ে নাক, চোখ, মুখ ছোবেন না। ঘনঘন সাবান পানি দিয়ে হাত ধুবেন।
জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল খাবেন। সর্দি-কাশির জন্য এন্টিহিস্টামিন (যেমন ফেক্সোফেনাডিন, ক্লোরফেনিরামিন ইত্যাদি) খেতে পারেন।
প্রয়োজনে ১৬২৬৩ বা ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে বিনামূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনার উপরোক্ত উপসর্গসমূহ থাকলে এবং বয়স ৬০-এর বেশী হলে বা অন্যান্য অসুস্থতা যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হাপানী, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থা থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
শ্বাসকষ্ট হলে বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জন সচেতনতায় – SoftClever Limited